দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন আক্রান্ত-মৃত্যু ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের সব রেকর্ড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় রাজধানীর ব্লাড ব্যাংক ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে রোগীর জন্য রক্ত ও প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়েছে। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রক্ত ও প্লাটিলেট সরবরাহ করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেটের কোনো ভূমিকা নেই। এ নিয়ে অযথাই ভয়-শঙ্কায় থাকে মানুষ। ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুঝুঁকি কমাতে প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তিত না হয়ে অন্য কিছু লক্ষণের দিকে নজর রাখা জরুরি।
সংকটময় পরিস্থিতিতেও প্লাটিলেটের ‘অপব্যবহার’ হচ্ছে
বিশিষ্ট ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, আমরা যারা রক্ত নিয়ে কাজ করি, দেশের বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে প্লাটিলেটের চাহিদাটা গভীরভাবে উপলব্ধি করি। কিন্তু যখন দেখি, এমন সংকটময় পরিস্থিতিতেও এর অপব্যবহার হচ্ছে, সেটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক।
তিনি বলেন, বর্তমানে প্লাটিলেটের ডোনার কিন্তু সহজলভ্য না। এই মুহূর্তে আমাদের ডোনারের তীব্র সংকট রয়েছে। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ঠিক মতো ডোনার পাচ্ছি না। এমন পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী প্লাটিলেটের অযাচিত ব্যবহার। সুতরাং অবশ্যই প্লাটিলেটের অপব্যবহার রোধ করতে হবে।
অপব্যবহার কেন বাড়ছে– এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আশরাফুল হক বলেন, বর্তমানে চিকিৎসক এবং রোগীর সম্পর্কটা একটা জটিল পর্যায়ে আছে, এখানে বিশ্বাসের বিষয়টা অনেকাংশেই জড়িত। যে কারণে চিকিৎসকরা চিন্তা করেন পরবর্তীতে কি না কি ঝামেলা হয়, তাই এখনই দিয়ে দিই। তাছাড়া রোগীরাও এখন একটু পড়ালেখা করে, তাই তারা ভাবে আমার রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ার আগেই দিয়ে দিই। এতে করে উপকার মিলতে পারে। এসব বিবেচনায় এখন রোগীদের আগেভাগে প্লাটিলেট দিয়ে দেওয়া হয়।
‘কিন্তু এতে করে যে সমস্যাটা হচ্ছে তা হলো– যে রোগীকে পাঁচ দিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হতো, সে জায়গায় এখন সাত থেকে ১০ দিন সময় লেগে যাচ্ছে’– যোগ করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
প্লাটিলেট সর্বনিম্ন কত হলে ভয়ের কারণ
দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি রক্তে প্লাটিলেট ৪০-৫০ হাজারের মধ্যে এলেই রোগীর স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা যায়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, প্লাটিলেট যদি ২০ থেকে ১০ হাজারের মধ্যেও নেমে আসে, এমন অবস্থায়ও রোগীর প্লাটিলেট না লাগতে পারে।
তিনি বলেন, প্লাটিলেট নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। রোগীর যদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় সেক্ষেত্রে নতুন করে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীর রক্তেরও প্রয়োজন হয় না।
এ বিষয়ে ডা. আশরাফুল হক বলেন, প্লাটিলেট ৫ হাজার কাউন্টেও অনেকে ভালো থাকেন। তার কোনো ধরনের লক্ষণ নেই, কোনো প্রকার রক্তক্ষরণ নেই। প্লাটিলেটের সঙ্গে কিন্তু রক্তক্ষরণের সম্পর্ক নেই। তার মানে হলো প্লাটিলেট ৫ হাজার কাউন্টেও যেমন রোগীকে খারাপ বলা যায় না, আবার এক লাখ দিয়েও ভালো বলা যায় না। অর্থাৎ কারো ক্ষেত্রে এক লাখেও রক্তক্ষরণ হতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে ৫ হাজারেও রক্তক্ষরণ হয় না।
তিনি বলেন, পুরো বিশ্বেই গাইডলাইন যেমনটি বলে, রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারে নেমে এলে প্লাটিলেট দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করার জন্য। কারণ শরীরের ভাইটাল যে অর্গানগুলো আছে, বিশেষ করে ব্রেনে রক্তক্ষরণ হলে সেটি রিকভার করা যায় না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে ১০ হাজারের নিচে এলেই প্লাটিলেটের বিষয়ে চিন্তা করার জন্য। এর বাইরে প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
কোন ধরনের খাবারে প্লাটিলেট বাড়ে?
অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, রক্তের প্লাটিলেটের সঙ্গে খাবার-দাবারের কোনো সম্পর্ক নেই। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে স্বাভাবিক খাবারই দিতে হবে। অতিরিক্ত কোনো খাবারের প্রয়োজন নেই। বেশি করে পানি খাওয়াতে হবে। লিকুইড জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ানো যেতে পারে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে প্লাটিলেট নিয়ে ভয়ে থাকেন, এমন অধিকাংশ রোগীরই প্লাটিলেটের প্রয়োজন হয় না। এমনকি অনেক রোগীকে রক্ত দিতে বলা হয়, আমি মনে করি সেটিও দেওয়া লাগে না। সুতরাং আমি মনে করি, রোগী এবং তাদের স্বজনদের এসব নিয়ে এত ভয়ের কোনো কারণ নেই। কিছু সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট এবং আলাদা রক্তের প্রয়োজন হলেও সেটি অবশ্যই কোনো চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন।
এ বিষয়ে ডা. আশরাফুল হক বলেন, ডেঙ্গুর এন্টিজেনটা আমাদের বোন ম্যারোতে সাময়িক সময়ের জন্য তার প্রোডাকশন কমিয়ে দেয়। এমনকি সাময়িক সময়ের জন্য রক্তটা ভেঙে যায়। এখন খাবার খেলে যে প্লাটিলেটের উৎপাদন বাড়বে, সেটা প্রমাণ হওয়ার আগে শরীর নিজেই সেটা উৎপাদন করা শুরু করে। সুতরাং খাবার খেলে রক্তে প্লাটিলেট বাড়ে বিষয়টা আসলে ‘ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে’।
তিনি আরও বলেন, প্রায় সময়ই বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, নিউট্রিশিয়ানিস্টরা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের পেঁপে পাতার রস খাওয়ার পরামর্শ দেন কিন্তু এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সুষম খাবারের জন্য মানুষকে সব সময় পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে কিন্তু আলাদাভাবে ডেঙ্গুর মুহূর্তে এসব জিনিস খেলে রক্তে প্লাটিলেট বাড়বে, এগুলো বলা মুশকিল। কারণ যার ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমবে, কোনো কিছুতেই সেটি ধরে রাখা সম্ভব নয়। তার কমবেই, এমনকি একটা সময় সেটি আবার রিকভারিও করে ফেলবে।
বিশিষ্ট এই ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ বলেন, কোনো ধরনের খাবার-দাবারের সঙ্গেই ডেঙ্গুর প্লাটিলেটের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ আমরা যদি দিনে দুটি করেও ডিম খাই, এতে করে আমাদের শরীরে যে প্রোটিন বাড়বে, সেটির রেজাল্ট আসতেও অন্তত ২১ থেকে ৪২ দিন সময় লাগে। তাহলে আমরা যে পেঁপে পাতা খাব আর এটি খাওয়ার কারণে তাৎক্ষণিক আমার যে এটা দিয়েই উপকার হবে, এটা কখনোই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত না।
প্লাটিলেট নিয়ে ভয়-শঙ্কা, যা বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের প্লাটিলেট নিয়ে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সমাজের অধিকাংশ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই প্লাটিলেটের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। কিন্তু ডেঙ্গু মূলত প্লাটিলেট ডিজঅর্ডার নয়, এক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণ হতে পারে প্লাজমা লিকেজ।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেটের কোনো ভূমিকা নেই। সুতরাং ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুঝুঁকি কমাতে প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তিত না হয়ে অন্য কিছু লক্ষণের দিকে নজর রাখা জরুরি।
রোবেদ আমিন বলেন, রোগীর রক্তচাপ কমে যাওয়া, অবসাদগ্রস্ততা, ঘাম হওয়া ও বমিভাব– এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীর শারীরিক অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করে ফ্লুইড বা স্যালাইন দেওয়া জরুরি। সঠিক সময়ে সঠিক ফ্লুইড না দিলে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুঝুঁকি থাকে বলে সতর্ক করেন তিনি।
প্লাটিলেট প্রয়োগে গাইডলাইন অনুসরণের পরামর্শ
এদিকে ডেঙ্গু সংক্রমণে প্লাটিলেট প্রয়োগে নির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, প্লাটিলেট জিনিসটা আসলে চেয়ে নেওয়ার বিষয় না। এটা নিয়ে আমাদের একটা ন্যাশনাল গাইডলাইন আছে, সেখানে সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে কখন প্লাটিলেট প্রয়োজন হবে, কখন দিতে হবে। এখন যদি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো গাইডলাইন অনুসরণ না করে, তাহলে তো এক কথায় তারা নিজেদের মতো চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। এমনটা তো হতে পারে না। আমি এটা চাই না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কথা হলো আপনারা গাইডলাইন অনুসরণ করুন। গাইডলাইনে বলা হয়েছে, প্লাটিলেট যদি ১০ হাজারে নেমে যায়, তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আর ৫ হাজারের নিচে নেমে গেলে বলা হয়েছে, আপনি ট্রান্সমিশন দিতে পারবেন। তবে, যদি কারও স্পেসিফিক ব্লিডিং হয় বা অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, এরকম কিছু ক্রাইটেরিয়া দেওয়া আছে। এই ক্রাইটেরিয়াগুলো পরিপূর্ণ হলেই তো প্লাটিলেট দেবে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্লাটিলেট আইডিয়াল ট্রিটমেন্ট নয়।
রোববার (২৩ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৭ হাজার ১৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৪ হাজার ১৪৯ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩ হাজার ২৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।
৩২৯৭৭ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, ১৭৬ জনের মৃত্যু
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৩২ হাজার ৯৭৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৯ হাজার ৯৪৯ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৩ হাজার ২৮ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৫ হাজার ৬২৬ জন। ঢাকায় ১৫ হাজার ৬৬১ এবং ঢাকার বাইরে ৯ হাজার ৯৬৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো। বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।