‘দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, চাম্পু ও চুম্পু’ এমন সব হরেক নামে পরিচিত চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম ভূঁইয়া। তিনি সেখানে আছেন এক যুগের বেশি। শুধু তাই নয়, একই দায়িত্ব পালন করেন মতলব পৌরসভায়ও। যেখানে সার্ভিস রুলে তিন বছর পূর্ণ হলে বদলি হওয়ার কথা। কিন্তু আবুল কালাম চাঁদপুরে কীভাবে খুঁটি গেড়ে আছেন সে নিয়েও আলোচনা আছে। তার দুর্নীতি-অনিয়মে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তার নাম দিয়েছে ‘আকাম ভূঁইয়া’।
পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে দাবি করেছেন, সর্বোচ্চ ব্যক্তি মেয়র হলেও পৌরসভায় আকাম ভূঁইয়ার কথাই শেষ কথা। মেয়র বললেও অনেক কাজ হয় না। কিন্তু আকাম ভূঁইয়া বললে হয়ে যায় এবং দ্রুতগতিতে হয়।
তার দুর্নীতির পরিমাণ শতকোটি টাকার কম নয়। জানতে চাইলে চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, ‘আবুল কালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে আমি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আশা করছি এক দেড় মাসের মধ্যে রিপোর্ট চলে আসবে। তারপরই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করলেও তিনি বলেন, সবই হয়েছে তিনি মেয়র পদে আসার আগে।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৌরসভার বিজ্ঞাপন থেকে বড় অঙ্কের টাকা লুটপাট হয়েছে। এ টাকা পৌরসভার ফান্ডে না এসে কারও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অথবা বিকাশে গেছে, এর সত্যতা আছে। মাস্টার রোলের নামে নয়-ছয় করে লোক নিয়োগের অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার সময়ে একজনও অ্যাডহক বা মাস্টার রোলে লোক নিয়োগ দিইনি। পৌরসভার অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছি।’ তার পরিচালনাধীন চাঁদপুর পৌরসভায় মাস্টার রোলে এখন ৭৩ জন কর্মচারী চাকরি করছে বলে স্বীকার করেন।
পৌরসভা থেকে পাওয়া গাড়ি নিজের পরিবারের জন্য ব্যবহার না করা এ মেয়র বলেন, ‘অনেক কিছুর বদলানোর উদ্যোগ আমি নিইনি কেন জানেন, সিস্টেমে চুরির সুযোগ থাকলে চোর চুরি করবেই। সিস্টেমে চুরির সুযোগ না থাকলে চোর কোনোভাবেই চুরি করতে পারবে না। আমি এতে ভীষণ বিশ্বাস করি।’
বদলি প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবর্তন করিনি। এটা করতে গেলে ঝক্কি-ঝামেলাও হয়। আমি চেয়েছি, এগুলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাজ, তারাই করুক।’
মাস্টার রোলে নিয়োগ অবৈধ হলেও নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মফিজ হালদার ৭৩ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে ৩৫ কোটি টাকা হাতিয়েছেন। বিজ্ঞাপন থেকে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ও বিকাশে ১৫ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। জ্বালানি তেলের খরচ দেখিয়ে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা লোপাটের ঘটনা সবার জানা।
এ বিষয়ে মেয়র জুয়েল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তেল ব্যবহারে প্রত্যেক পৌরসভায় বাজেট থাকে। মাসে ২১০ লিটার। যে হিসাবকে সিলিং বলে। এ পৌরসভায় জ্বালানি তেল ব্যবহারের কোনো সিলিং ছিল না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তা চালু হয়েছে।’
আবুল কালাম ওরফে আকাম সিন্ডিকেটের লোপাটের অন্য ক্ষেত্রগুলো হলো পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন দেখিয়ে মাসিক ১৪ লাখ করে ১০ বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। পাশাপাশি ‘সুইপার বিল’ নাম দিয়ে মাসে দুই বা ততোধিকবার প্রায় ৫ লাখ টাকা করে ১০ বছর ধরে তুলেছে চক্রটি। অর্থাৎ এ খাতে ১৫-২০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জাল নথি বানিয়ে ২০ বছরে নামে-বেনামে মফিজ হালদার প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোপাট করেছেন। এ ছাড়া টেন্ডার/কোটেশন ছাড়াই মফিজ হালদার শতকোটি টাকার কেনাকাটা দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।
‘আকাম’ সিন্ডিকেট একটানা গত ১০ বছরে উৎকোচ গ্রহণ করে পৌরসভার সম্প্রসারিত বা বর্ধিত বহুতল ভবনগুলো করের আওতাভুক্ত করেনি। এভাবে তারা প্রতি বছর ৫-৬ কোটির ক্ষতি করেছে পৌরসভার। সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য নাসির উদ্দিন খান পৌর তহবিলের কোটি টাকা ও লিজ দেওয়ার নামে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ অভিযোগে বাজার পরিদর্শককে শুধু বরখাস্ত করেই কর্তব্য শেষ করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
দুর্নীতির অভিযোগে পৌরসভার কর্মকর্তা (অ্যাসেসর) সুলতান আহমেদকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে একটি স্কুলে পদায়ন করেছে পৌরসভা। তিনি বলেন, ‘আকাম ভূঁইয়ার খপ্পরে পড়েই আজ আমি সাজাপ্রাপ্ত। আমাকে পৌরসভার বিজ্ঞাপন বিল নিয়ে লুটপাট করার কর্মকৌশল শিখিয়ে দিয়েছে এই চক্র। বিজ্ঞাপন করের নথি এনে দিয়েছে আমাকে। দুজনের নির্দেশমতো এ দুর্নীতি-লুটপাট করতে বাধ্য হয়েছি। আকাম ভূঁইয়ার কথা না শুনে আকাম না করলে চাকরিও করতে পারতাম না।’
আত্মীয়স্বজন কাউকে মুখ দেখাতে পারেন না উল্লেখ করে সুলতান বলেন, ‘পৌরসভার লোকজন, বন্ধুবান্ধব দেখলে পালিয়ে বেড়াই। এমনও হয় কখনো মাদ্রাসার মেসে, কখনো মসজিদে রাত কাটাই। আমাকে বিজ্ঞাপনের টাকা লুটপাট করতে বাধ্য করেছে, বাজার করের টাকা নয়-ছয় করার নির্দেশ দিয়েছে। এখন আমি শাস্তির আওতায় অথচ যারা আমাকে দিয়ে বাধ্য করিয়েছে তারা বহাল তবিয়তে পৌরসভার টাকা আত্মসাৎ করেই চলেছে।’
মেয়র এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৌরসভায় অনিয়ম করার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় সুলতানকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে।’
পৌরসভার সাধারণ নাগরিকরাও জানেন বর্তমান ও সাবেক দুই মেয়রই ‘আকাম ভূঁইয়া’র হাতের পুতুল। নাম প্রকাশ না করে এক বাসিন্দা বলেন, ‘চাঁদপুর পৌরসভার অনেকেই জানে পৌরসভার সম্পত্তি লিজ দেওয়ার নামে মানুষজনের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও টিকে আছেন আকাম-মফিজ সিন্ডিকেট।’
কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, মেয়র জুয়েল পৌরসভার সিন্ডিকেট ভাঙা, দুর্নীতি দমন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। তারা দাবি করেন, আকাম ভূঁইয়াা-মফিজ চক্র মেয়রের নিজস্ব লোকজনকে দলে ভিড়িয়ে সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করেছে।
জানা গেছে, ‘আকাম ভূঁইয়া’ এখনো উৎকোচ নিয়ে সম্প্রসারিত ভবনের পৌর কর নেন না, নতুন হোল্ডিং, মিউটেশন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ, ভবনের নকশা অনুমোদন, যৌথ জরিপ, ট্রেড লাইসেন্স দিতে ঘুষ নেন। দিনে দিনে তার ঘুষের রেট বেড়েছে। তার অবৈধ আয়ের আরও খাতের মধ্যে আছে হাট-বাজার, গরুর বাজারের ইজারার কোটি কোটি টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা না দেওয়া, পৌরসভার ভূমি লিজ-দোকান বরাদ্দ ও মিউটেশনে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া। অটোরিকশা, টমটম এসব গাড়ির লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে দৈনিক ১৫০ ও মাসিক ৪ হাজার টাকা করে নেন। আবার অবৈধ যানের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন।
অবৈধ আয়ের টাকায় ‘আকাম ভূঁইয়া’ চাঁদপুর পৌরসভায় বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছেন। শহরের নাজিরপাড়ায় এই বাড়ির নাম রেখেছেন তাজ ভিলা। ওই এলাকায়ই একই আদলে একই মাপে বাড়ি করেছেন মফিজ হালদার।
দুজনের বাড়ি একই রকম হলো কীভাবে এ প্রশ্নে আবুল কালাম ওরফে আকাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই বিষয়টি মফিজকেই জিজ্ঞেস করেন। আমি আমার পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করে ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এ বাড়ি করেছি।’
দুর্নীতি ছাড়াও আবুল কালাম পৌর কর্মচারী সংসদের সভাপতি পদ দখল করে আছেন। মফিজসহ তারা দুজন মিলে লাখ লাখ টাকা বিলিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ফরিদগঞ্জ ফাউন্ডেশন, নাইট রাইডার্স ক্লাব, অফিসার্স ক্লাবের আদলে এলিট প্রশাসনিক/ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘এভারগ্রিন ক্লাব’ ‘ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমি’।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা।’
তবে এ চক্রের দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ পৌর বাসিন্দা কামরুল বলেন, ‘সামনে ইলেকশনে আকাম-মফিজরা নৌকায় ভোট দিলেই হইবো, আমাগো আর লাগবো না। সূত্র : দেশ রূপান্তর।
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো। বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।